কথায় আছে “যার ভুত-ভবিষ্যত নেই, সেই বেশি অতীত স্মৃতিকাতর।” আমি মনেহয় খুব বেশিই স্মৃতিকাতর ! খুব খুব মিস করি আমার ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর। শৈশবের ঐসব দূরন্তপনাময় দিনগুলি এখন শুধুই স্বপ্ন ।দ্বৈত কিছু নিয়ামক স্মৃতি গুলোকে বিস্মৃতির অতলান্ত হতে সামনে নিয়ে আসে, যেন পঁচা কাদামাটি চাপা মিথেন গ্যাস জল ঠেলে বুঁদ বুঁদ আকারে উঠছে। খুব বেশি স্কুল বদলানোর নজির নেই, আর তাই নিত্য নতুন বন্ধু বানানোর ঝামেলাও ছিলো না আমার।শিক্ষা জীবনের একটা সময়ই শুধু স্কুল পাল্টেছিলাম তাও ১ বছরের জন্য।চেনা বন্ধু-বান্ধব, চেনা পথ, চেনা স্কুল ঘর আর আমার পিতৃতুল্য শিক্ষকমন্ডলী ছেড়ে যেতে হয়েছিল, সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশে । ইন্ট্রভার্ট আমি কেমন করে যে মিশে গেলাম সবার সাথে, এটা ভাবলেও আমার অবাক লাগে। দূর-দুরান্ত হতে কত সব বন্ধুরা আসতো, আর তাদের হাল্কের মতো দানবীয় সব শরীরের কাছে আমি যেনো চুনো পুঁঠি।তবে বন্ধু ভাবতে একটুও সংকোচ বোধ হয়নি, ব্যাপারটা হয়তো সহজ হয়েছিলো আমার মতো আরো কিছু চুনোপুঁটি বন্ধু পেয়ে।হয়তো বন্ধুত্ব ব্যাপারটা আরো গতি পেয়েছিলো প্রয়াত আখতার স্যারের (হুকো স্যার) কাছে প্রাইভেট পড়তে যেয়ে। ব্যাপার টা সহজ হয়ে গেলো, যখন আরো কজন জুটলো আমার পুরোনো স্কুলের সহপাঠি। সত্যি এক-একটা দিন যেন কাব্যগ্রন্থের এক-একটা পূর্নাঙ্গ কবিতা। দিন শুরু হতো সকাল বেলার পাখির কলতান দিয়ে ঘুম ভাঙ্গা। মুখ-হাত ধুয়ে কিছুক্ষন পড়তে বসা। পুকুরের পানিতে নয় শ্যালোর পানিতে চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত গোসল, সকালের খাবার শেষে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরা। ধুলিময় পথ মারিয়ে স্কুলের গ্রাউন্ডে পৌঁছা। মরিয়ম ম্যামের কঠর অনুশাসন মেনে টিফিন শেষে ক্লাসে ঢুকাও রিতি মতো এক যুদ্ধ। আবার মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম, হঠাৎ মাঝ ক্লাসে যখন প্রচন্ড রাগী মোকছেদ স্যারও দরাজ গলায় আব্বাসউদ্দীনের গান “কূল নাই, কিনার নাই, নাইকো দইড়ার পানি............” গেয়ে উঠতেন। পড়া না পারলে মকবুল হোসেন স্যারের গাল টেনে বলা “কি হাঁসি ফ্যাকোর ফ্যাকোর একো দিন যাবে একো বছর” কথার মর্মার্থ সেদিন না জানলেও আজ তা জ্বলবৎ তরলং। আখতার স্যারের অংক ক্লাসে অমনোযোগী হওয়ায়, কখনও চক আবার কখনও ডাস্টারের ঢিল খাওয়া, আর অংক না পারলে কখনও সখনও একতলায়(সিট বেঞ্চে) দাড়ানো, আবার কখনও দোতলায় (হাই বেঞ্চে) দাড়ানো । বিকেল বেলা প্রায়ভেট পড়ার ফাঁকে স্যার নামাজে বসলে লুকিয়ে বকুল ফুল পারা, সে কি যে রোমাঞ্চকর তা সত্যি অনবদ্য।সামাদ স্যারের পিটি ক্লাস তো নয় যেনো কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের ডিসপ্লে। বিজ্ঞান ক্লাসে যখন বিজ্ঞান পড়াতেন যেন গল্পের ছলে সব শিখিয়ে দিচ্ছেন। বন্ধুদের তালিকা যদিও অনেক লম্বা ছিলো, তারপরও তন্মধ্যে উল্লেখ্য যাদের আর পরের ক্লাসে পাইনি এমন, মেয়ে বন্ধু মরিয়াম, লুৎফুন নাহার, শ্যামলী, হিরা, মিভা.... ছেলে বন্ধুদের মাঝে, হিন্দু ছেলে গুলো বামেশ, লুটু, বিদ্যুৎ আরও কয়েকজন। ছেলে গুলোর মাঝে বিদ্যুতের কথা বেশি মনে পরে, হয়ত একরকম পাপবোধে বিদ্ধো তাই। আমাদের যাদের দূরে বাড়ি তারা অধিকাংশ দিনেই বাসা হতে টিফিন নিয়ে আসতাম। আর টিফিন নিয়ে যতো দুষ্টুমি করতাম তা আজ মনে হলে হাসি পায় নয়তো অপরাধ বোধ কাজ করে। মজার ব্যপার হচ্ছে টিফিনের সময়ে মায়ের সযত্নে তুলে দেয়া মাছ, ডিম বা গোস্তের টুকরো টা কেউই খুঁজে পেতাম না। একজনের টা অপর জনে খেয়ে নিত টিফিনের আগেই, তাই কখনো স্যারের কাছেও এব্যপারে নালিশ যাবার কথা তেমন একটা স্মরণে নেই। তবে আমার এই দুষ্টুমি সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের টিফিন ক্যারিয়ারের কোনো তরকারিই বাদ যেত না, এমনকি যে পাতা-কচুর ডাল বা ভাজি। এক প্রকার জোর করেই নিয়ে খেতাম আমাদের গুলো ওঁকে দিতাম। জানিনা সহজ-সরল নিপাট ভালমানুষ বন্ধুটি আমার সেই জ্বালাতন কিভাবে নিতো। দেখতে দেখতে ২০ বছর শেষ হয়ে ২১ বছরে সময়ের কাঁটা। জানিনা বিদ্যুৎ তুই কোথায় আছিস ? কেমন আছিস? জীবনের ফেরে, অন্য সকলের সাথে কোথাও না কোথা দেখা হয়েছে। তোর সাথে দেখা হবার আর সুযোগ মেলেনি। ছোট্ট বেলার ঐসব দুষ্টুমি গুলো যদি জ্বালাতন মনে করিস তো নিজ গুনে ক্ষমা করিস।
|
Reciter's blog/
|